শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫, ০২:৫৯ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক॥
শিক্ষায় আলোর বাতিঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যে কোন শিক্ষার্থী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়লে শিশু শ্রেনীতে পা রেখেই শুরু হয় তার বাতিঘরের আলো দেখা। সেখান থেকেই একজন শিশু শিক্ষার্থী তার আদর্শ ধারণ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সর্বত্র শিক্ষায় বাতিঘর হিসেবেই মনে করেন। সেই আলোর বাতিঘরটি পদ্মায় ভেঙেছে তিনবার। ভাঙনের ফলে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে বিদ্যালয়টি। শুধু একবার নয়। তিন-তিনবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমিসহ ভবন চলে গেছে পদ্মা ভাঙনে। শিক্ষায় আলোর বাতিঘরের সাথে যেন আঁধারের গল্প গাঁথা রয়েছে।
বলছিলাম ঢাকার দোহার উপজেলার নয়বাড়ি ইউনিয়নের ৪ নং অরঙ্গবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা। পদ্মা নদীর নিকটবর্তী বিদ্যালয়টি অবস্থিত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এলাকার শিক্ষার মান বিকাশে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল অরঙ্গবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। একসময়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রাক্ষুসে পদ্মায় কেঁড়ে নিয়েছে তিনবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভবন ও জমি। বারবার পদ্মায় ভাঙনে এলাকায় বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বর্ষার মৌসুমে ভয়ে শিক্ষার্থীরা যেতে চায় না বিদ্যালয়ে। এভাবে এই আতঙ্ক বিরাজের মধ্য দিয়ে এরপর থেকে এই বিদ্যালয়ে তেমন আর শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় না। আশপাশের বিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হন অনেকেই।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দোহার উপজেলার শেষ সীমানা পদ্মার পাড় ঘেষে ও নবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত এই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। প্রথম বার ২০০৬ সালে অরঙ্গবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির ভবন ও জমি ভেঙে পদ্মায় চলে যায়। সে সময়টা বিদ্যালয়টি নয়বাড়ি ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডে ছিল। সেখান থেকে পাশেই ১ নং ওয়ার্ডের আওতাধীন স্থানে বিদ্যালয়ের নামে জমি কেনা হয়। কিছুদিন পর ওইসময় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ভবন নির্মাণ করে দেয়া হয়। ২০০৬ সালের নির্মাণ করা নতুন ভবনে কয়েক বছর শিক্ষাদান কার্যক্রম চলার পর, ২০১২ সালে পদ্মা ভাঙন শুরু হয়। সে সময় ওই গ্রামের অনেক বসতবাড়ি পদ্মায় চলে যায়। দ্বিতীয় দফায় ২০১২ সালে বিদ্যালয়ের জমি ও ভবন ভেঙে পদ্মায় চলে যায়। প্রথমবারের মত দ্বিতীয়বারও একই অবস্থা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যালয়ে শ্রেণী কক্ষে পাঠদান ও সকল কার্যক্রম। সরকারি ইটের ভবন পদ্মায় ভেঙে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে আবারও দাঁড় করাতে স্থানীয়রা উদ্যোগ নিয়ে টিনসেট ঘর নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভাঙনের কিছুদিন পর নতুন করে কার্যক্রম শুরু করেন। এভাবে কয়েক বছর চলার পর এলাকার ছোট ছোট কোমলমতি শিশুরা এই অরঙ্গবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করেন। পদ্মা পাড়ের মানুষ হিসেবে পড়ালেখায় মনোযোগীও অনেক ভালো এখানকার শিক্ষার্থীরা। এভাবে চলতে চলতে ২০১৬ সালে সেই রাক্ষুসে পদ্মায় গিলে খেলো বিদ্যালয়টি। সেসময় ভারী ভাঙনে জমিসহ বিদ্যালয়ের ভবন বিলীন হয়ে যায়। এরপর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত হতে শুরু করে গ্রামের মানুষ। দীর্ঘদিন পাশেই একটি ছোট্ট টিনের ঘরে ক্লাস নিয়ে কোন রকমে পাঠদান করাতেন শিক্ষকরা। এভাবে চলতে থাকলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিনদিন কমতে থাকে। এরপর ভাঙন রোধে পদ্মা পাড়ের বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এরপর বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে সাহস পায় কর্তৃপক্ষ। আস্থা ফিরে আসে এলাকার মানুষের মাঝে।
এরপর আগের ১ নং ওয়ার্ড আওতাধীন থেকে ৩ নং ওয়ার্ডে এসে সরকারি ভাবে ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় ৩৩ শতাংশ জমি কেনা হয়। এরপর সর্বশেষ ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে টিনের পাকা স্কুলঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। পুরোদমে শুরু হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার বাতিঘরে আলোর মাঝে শিশুদের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ। পদ্মায় বাঁধ নির্মাণের পর এ পর্যন্ত আর ভাঙন কবলে পড়তে হয়নি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ৬ বছর যাবৎ এই টিনের পাকা স্কুল ঘরে শ্রেণী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে পদ্মা পাড়ের শিক্ষার্থীরা। এখন আর পদ্মা ভাঙনের কোন আশঙ্কা নেই। ভাঙন রোধে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর এত বছরের বিদ্যালয়টি এখনও দোহার উপজেলার অনান্য বিদ্যালয়ের তুলনায় অবহেলিত। বিদ্যালয়ে দুটি টিনের পাকা ঘর রয়েছে। একটিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয়। তবে পাশে অন্য আরেকটি ঘর পাশেই এক ড্রোজার ব্যবসায় ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করছেন। মাথে তাদের রাখা হয় এবং শ্রমিকরা এই স্কুল ঘরে বসবাস করেন। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে সরকারি স্কুলঘর দখলে করে ব্যক্তি সুবিধা নিলেও এ যেন দেখার কেউ নেই। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও কোন সমাধানের উদ্যোগ নেই। শুধু ঘরই নয়, বিদ্যালয়ের মাঠটি অনেক সুন্দর। শিশু শিক্ষার্থীরা টিফিন সময়ে খেলাধুলা করেন। অথচো ওই মাঠের উপর ড্রেজারের পাইপ ফেলে রাখা হয়েছে। এতে যেমন শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না, তেমনি বিদ্যালয়ের সৌন্দর্য হারাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এছাড়া সরকার স্লিপ ও মেরামত ফ্রান্ডে যেসব বরাদ্দ দেয় ওই বরাদ্দ দিয়ে বিদ্যালয়ের উপকরণ ক্রয় ও সঠিক ভাবে মেরামতের কাজ করালে পাল্টে যেতে পারে বিদ্যালয়ের চিত্র।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে নিয়মিত মনিটরিং এর অভাবে অবহেলায় পড়ে আছে বিদ্যালয়টি। দায়িত্বরত সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে বিদ্যালয়ের জমি ও ঘর ব্যবহার করছেন স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। এসব সমাধানের দাবি জানিয়ে গণমাধ্যমকে বক্তব্য দেন এখানকার বাসিন্দারা।
সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গেলে দেখা যায় এমন চিত্র। এসব দেখে কথা হয় শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আমেনা রহমান মাইসা, চতুর্থ শ্রেণীর দোলা আক্তার, ও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র মোস্তাকিম এই প্রতিবেদককে বলেন, বিদ্যালয়ের সুন্দর ও ভালো ভবন হলে আমাদের জন্য ভালো হবে এবং সুন্দর ভাবে পড়াশোনা করতে পারবো। বিদ্যালয়ের ময়লা আবর্জনা আমরা নিজেরা পরিস্কার করে থাকি। আমার এখনও অনেক ছোট। আমাদের দ্বারা এসব কাজ অনেক কষ্ট হয়ে যায়। এসব কাজের জন্য আমাদের এই স্কুলে একজন দপ্তরি প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, বিদ্যালয়ে লাইট নেই। চারটি লাইট ছিল, তিনটি লাইট চুরি হয়ে গেছে। তাই অন্ধকারে ক্লাস করতে সমস্যা হয়। আমরা চাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেন এসব বিষয়সহ আমাদের খোঁজখবর নেয়। অরঙ্গবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ৭৪ জন। আর সহকারী শিক্ষক রয়েছেন দুই জন। নেই কোন প্রধান শিক্ষক। এই দু’জন শিক্ষক দিয়েই চলে শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। একজন লিপি আক্তার আরেকজন তানিয়া আক্তার। তবে জৈষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে লিপি আক্তারকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লিপি আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, এখানে আরও শিক্ষক প্রয়োজন।
ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা তুলনা অনুযায়ী শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া একজন দপ্তরি প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, মানসম্মত শিক্ষার জন্য আমরা সর্বত্র চেষ্টা চালিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছি। যেহেতু এখন পদ্মা ভাঙ্গনরোধ হয়েছে তাই বিদ্যালয়ে একটি ভবন হলে ভালো হয়। সহকারী শিক্ষক তানিয়া আক্তার বলেন, বিদ্যালয়টি তিনবার পদ্মায় ভেঙেছে। আমার বাড়ি পাশের গ্রামেই। আমার চাকুরী হওয়ার আগে থেকেই শুনেছি বিদ্যালয়টি পদ্মা ভাঙন কবলে পড়েছে কয়েকবার। এই বিদ্যালয়ে যোগদানের পর জানতে পেরেছি তিনবার ভাঙার পর চতুর্থবারের মত এখানে টিনের পাকা স্কুলঘর উঠানো হয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে, আরও শিক্ষক প্রয়োজন বলেও জানান তিনি। এসব বিষয়ে কথা বলতে দোহার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দা পারভীনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে রিসিভ করেনি। তবে এই ইউনিয়নে (ক্লাস্টার) দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মারুফ হোসেনকে মুঠোফোনে সংযোগ দিলে তিনি জানান তিনি হাসপাতালে আছেন।
এ বিষয়ে দোহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইলোরা ইয়াসমিন প্রতিবেদককে মুঠোফোনে বলেন, যেহেতু এটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তাই এই বিদ্যালয়ের যিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি আমাকে অবগত করলে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক সংকটসহ অনান্য বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলা হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন কোন ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।